Sunday, June 21, 2015

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০৩


রোজালিন নামটাই বারবার ঘুরতে লাগল রোমিওর
মাথায়। ঐ তালিকায় রোজালিনের নামও
রয়েছে। সে স্থির করল যা হয় হোক, শুধু
রোজালিনকে দেখতেই ক্যাপুলেটদের নৈশ
ভোজের আসরে যাবে। রোমিওর ভাবনা আন্দাজ
করে তাকে ঠাট্টা করে বলল বেনভোলিও, ‘আরে
এরে ভাববার কী আছে। রোজালিনের জন্য মন যখন
এতই খারাপ, তখন ঝুঁকি নিয়েই ক্যাপুলেটদের
বাড়ি গিয়ে দেখে এস তাকে।’
বন্ধু যে ঠাট্টা করছে তা বুঝতে না পেরে রোমিও
বলল, ‘যাবই তো, গিয়ে প্রাণ ভরে দেখে আসব
তাকে।’
বেনভোলিও বলল, ‘বেশ তো, যাও। হয়তো আজই
তোমার শেষ দিন। রোজালিনকে দেখার পর
এককোপে তোমার গর্দান নামিয়ে দেবে
ক্যাপুলেটরা।
কার্কুসিও বলল, ‘যত ঝুঁকি আর বিপদের ভয় থাকুক
না কেন, তোমার কিন্তু সেখানে যাওয়া উচিত।
ভেরোনার সুন্দরীরা সেজেগুজে জড় হবে
সেখানে। তাদের মধ্যে কাউকে মনে ধরে গেলে
রোজালিনকে ভুলে যাবে তুমি—কেটে যাবে
তোমার মোহ।’
রোমিও স্থির করল মোহ কাটাতে নয়, প্রাণভরে
রোজালিনকে দেখার জন্যই ঝুঁকি সত্ত্বেও
ক্যাপুলেটদের বাড়ির নৈশভোজের আসরে যাবে
সে। তবে সে একা যাবে না, সাথে থাকবে দু-বন্ধু
মার্কুসিও আর বেনভোলিও। তিন বন্ধু স্থির করল
শত্রুর চোখে-ধুলো দেবার জন্য তারা ছদ্মবেশ ধরে
যাবে।
ফুল আর আলোর রোশনাইয়ে সেজে উঠেছে
ক্যাপুলেটদের প্রাসাদসম বাড়িটা। ভেরোনার
অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা নাচ-গানে মেতে
উঠেছে ভিতরের বিশাল হলঘরে। তাদের দেখলে
মনে হবে রূপ-যৌবন যেন উপচে পড়েছে তাদের
দেহে—তারা যেন মর্তের মানুষ নয়, রূপকথার
কাল্পনিক স্বর্গ থেকে যেন তারা নেমে এসেছে।
দামি পোশাক পরিধান করে ক্যাপুলেটদের
বুড়োকর্তা দাঁড়িয়ে রয়েছেন হলঘরের দরজায়।
তার একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়ির একজন
সুন্দরী পরিচারিকা—তার হাতের সাজিতে
সাজানো রয়েছে একগুচ্ছ ফুটন্ত গোলাপ কুঁড়ি।
কিছুক্ষণ বাদে সেখানে এসে পৌঁছালেন কাউন্ট
প্যারিস। তাকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্থ হয়ে পড়লেন
বুড়োকর্তা। কাউন্ট শুধু দেখতে সুন্দর নন, প্রচুর ধন-
সম্পত্তির মালিক তিনি। তার সাধ হয়েছে
বুড়োকর্তার একমাত্র মেয়ে জুলিয়েটকে বিয়ে
করার।
বহুদিন হল মারা গেছে বুড়োকর্তার অন্যান্য
ছেলেমেয়েরা। বেঁচে আছে শুধু চোদ্দ বছর বয়সি
জুলিয়েট। কাউন্ট প্যারিসের সাথে জুলিয়েটের
বিয়েতে আপত্তি নেই বুড়োকর্তার, কিন্তু তিনি
চান না এখনই বিয়ে হয়ে যাক এই ছোট্ট মেয়েটার।
তিনি কাউন্টকে বলেছেন মেয়েটার ষোলো বছর
বয়েস হলে তিনি তার বিয়ে দেবেন। দু-বছর যথেষ্ট
সময়। কাউন্ট ইচ্ছে করলে এ সময় জুলিয়েটের সাথে
মেলামেশা করতে পারেন। বুড়োকর্তার তরফে এ
নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। আর এ মেলামেশার
ফলে কাউন্টকে ভাবী স্বামী বলে মেনে নেবার
জন্য মানসিক দিক দিয়ে তৈরি হতে পারবে। এ
কথা অবশ্য ঠিক যে জুলিয়েটের মতো বয়েসে তার
গিন্নি অনেকগুলি সন্তানের মা হয়েছিলেন।
গায়ক-বাদকদের ছদ্মবেশে অতিথিদের মধ্যে
মিশে গিয়ে রোমিও ও তার দু-বন্ধু এক সময় ঢুকে
পড়ল ক্যাপুলেটদের প্রাসাদের ভিতরে। এরা কেউ
ক্যাপুলেট পরিবারের সদস্যদের ধারেকাছেও
ভেড়েনি। বাড়ির মেয়েরা যেখানে সমবেত
হয়েছে, তাদের তিনজোড়া চোখ সেখানেই খুঁজে
বেড়াচ্ছে রোজালিনকে। কিন্তু রোজালিনকে
খুঁজতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটে যাবে তা কল্পনাও
করতে পারেনি রোমিও আর তার দুই বন্ধু।
তার দু-বন্ধু বারবার তাকে সাবধান করে দিয়ে
বলেছে, ‘ওভাবে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থক না,
সামনে এগিয়ে চল।’ কিন্তু সেদিকে কোনও হুঁশ
নেই রোমিওর। পলকহীন দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে
সে চেয়ে আছে আর মাঝে মাঝে বন্ধুদের বলছে,
‘কে-রে ভাই ওই মেয়েটা? দোহাই তোদের, ওর
নামটা একবার জেনে আয় না।’
কিন্তু মন্দ ভাগ্য রোমিওর। তাই মেয়েটির পরিচয়
জানার আগেই ক্যাপুলেটরা জেনে গেল রোমিওর
আসল পরিচয়। তার পরিচয়টা যে জানল সে হল
ক্যাপুলেট পরিবারের সবচেয়ে শয়তান লোক টিবল্ট
—মন্টেগুদের নাম শুনলে যে তেলে-বেগুলে জ্বলে
ওঠে। সে একটা চাকরকে ডেকে বলল, ‘যা দৌড়ে
গিয়ে, আমার তলোয়ারটা নিয়ে আয়।’
চাকরটা তলোয়ার আনতে যাবে এমন সময় সেখানে
এসে পৌঁছলেন ক্যাপুলেট বাড়ির বুড়োকর্তা।
টিবল্ট যে চাকরকে ডেকে তলোয়ার আনতে
বলেছে সে কথাটা শুনেছেন তিনি আর তাতেই
বুঝে গেছেন কোনও একটা গুরুতর ব্যাপার ঘটেছে।
বুড়ো কর্তা টিবল্টকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী
হয়েছে রে তোর? অযথা কেন মাথা গরম করছিস
আজকের দিনে?’
দূর থেকে রোমিওকে দেখিয়ে বলল টিবল্ট, ‘আমি
অযথা মাথা গরম করছি না। ওই যে বাজনাদারের
পোশাক পরা ছেলেটিকে দেখছ, ও হল মন্টেগু
বাড়ির রোমিও। নিশ্চয়ই ওর কুমতলব আছে, নইলে
ছদ্মবেশে আসবে কেন। আমি ওর কান দুটো কেটে
নেব তলোয়ার দিয়ে।’
টিবল্টের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন
বুড়োকর্তা, তারপর বললেন, ‘তোমার সাবধান করে
দিচ্ছি আমি। রাজার ধমক খাবার পরও তোর শখ
মেটেনি লড়াই করার? আমি তো নিজে দেখেছি
রোমিওকে। কী সুন্দর ওকে দেখতে। তাছাড়া
শত্রু হওয়া সত্ত্বেও সে নিজে যখন আমাদের
বাড়িতে এসেছে তখন সে আমাদের অতিথি।
তাকে সম্মান না হয় না জানালি, তাই বলে তার
কান কেটে নিবি? এ কেমন কথা? ক্যাপুলেট
বাড়ির ছেলের মুখে এ কথা সাজেনা। আমার
সাবধানবাণী সত্ত্বেও যদি তুমি ওর গায়ে হাত
তোল, তাহলে তার ফল তুমি একাই ভোগ করবে।
বিচারের সময় আমি কিন্তু তোমাকে বাঁচাতে
যাব না। সে কথা মনে রেখ।’ বুড়োকর্তার
ধমকানিতে শেষমেষ ঠাণ্ডা হল টিবল্ট।
ক্যাপুলেটরা যে রোমিওকে চিনতে পেরেছে সে
কথা কিন্তু তখনও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি সে।
তার মন পড়ে রয়েছে সেই অল্পবয়সি সুন্দরী
মেয়েটির দিকে। সে জানে সুন্দরী মেয়েদের মন
জয় করার উপায় হল সাহসে ভরে করে তাদের
সাথে যেতে আলাপ করা। কিছুদূর গিয়ে বন্ধুদের
চোখের আড়ালে পাঁচিল টপকে সে লাফিয়ে পড়ল
ক্যাপুলেটদের বাগানে। এতসব হই-হট্টগোলের
মাঝেও সে যেচে গিয়ে আলাপ করছে মেয়েটির
সাথে। মেয়েটি বেশ ভালোভাবেই কথাবার্তা
বলেছে তার সাথে। তাই দেখে রোমিও ধরে নিল
মেয়েটিরও নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে। কিন্তু অসুবিধা
এই মেয়েটির নাম পর্যন্ত জানে না সে। সেটাই
সবসময় খোঁচাতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে মেয়েটির
ধাই-মা এসে ‘জুলিয়েট’ বলে ডাকল তাকে। আর
তখনই রোমিও জানতে পারল মেয়েটির নাম
‘জুলিয়েট’। ধাই-মাকে জিজ্ঞেস করে রোমিও
জানতে পারল জুলিয়েট সবে তেরো ছেড়ে চোদ্দে
পা দিয়েছে—আর ক্যাপুলেট কর্তার একমাত্র কন্যা
সে।
মনে মনে আক্ষেপ করে রোমিও বলল, ‘হায় ভগবান।
একি হল? এই পরমাসুন্দরী মেয়েটি কিনা আমাদের
চিরশত্রু ক্যাপুলেট কর্তার একমাত্র মেয়ে?’ কিন্তু
শত্রুর মেয়ে হলে কী হবে? প্রথম দেখা থেকেই
রোমিও এত ভালোবেসে ফেলেছে জুলিয়েটকে,
যে তার পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব নয় জুলিয়েটকে
ছেড়ে থাকা।
আবার একই সমস্যার মাঝে পড়েছে জুলিয়েট।
রোমিওকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে খুবই
ভালো লেগে গেছে জুলিয়েটের। এখন নিজের
উপরই রাগ হচ্ছে কেন সে সময় ছেলেটির নাম
জেনে নেয়নি। তবে সে লক্ষ করেছে ছেলেটি
ধাইমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার
সাথে কথা বলছিল। তাই সে ধাইমাকে ডেকে
জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা ছেলেটির নাম কী?’
কোন ছেলেটির কথা জুলিয়েট জানতে চাইছে
সেটা বুঝতে প্রেও মুখে বলল ধাইমা, ‘কার কথা
বলছ মেয়ে? অনেক ছেলেই তো এসেছিল। নেচে-
গেয়ে, খেয়ে-দেয়ে তারা সবাই বিদায় নিল।’
আদুরে মেয়ের মতো ধাইমার গলা জড়িয়ে বলল
জুলিয়েট, ‘ওই যে গো ধাইমা, রাজপুত্তুরের মতো
দেখতে সেই সুন্দর ছেলেটা—যার পরনে ছিল
বাজনাদারের পোশাক, আবার নাচিয়েদের মতো
রংও মেখেছিল মুখে। আমি সেই ছেলেটার কথা
বলছি যখন আমায় ডাকতে এসে তুমি তার সাথে
কথা বলছিলে।’
ধাইমা বলল, ‘এত ছেলে এল গেল, সে সব বাদ দিয়ে
ওকেই কিনা তোর পছন্দ হল’ বলেই নিজেকে
সামলিয়ে নিলে সে। তারও একদিন রূপ-যৌব ছিল।
সে জানে অপরিচিত ছেলের নাম জানার জন্য
কমবয়সি মেয়েরা কত না আগ্রহী হয়। ধাইমার মনে
হল আগে রোমিওর পরিচয় জানিয়ে দিলে তার
উপর থেকে জুলিয়েটের আকর্ষণ আপনা থেকেই
উবে যাবে।
জুলিয়েটের কানের কাছে মুখটা নিয়ে ধাইমা
বলল, ‘তুমি ওই ছেলেটার নাম জানতে চাইছ? ও হল
আমাদের চিরশত্রু মন্টেগুদের একমাত্র বংশধর—নাম
রোমিও। তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি এ
বাড়িতে ওর নাম উচ্চারণ করবে না তুমি। তাহলে
কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। রোমিও এ
বাড়িতে আসায় ওর কান কেটে নিতে চেয়েছিল
টিবল্ট। অনেক বকাঝকা করে তাকে ঠাণ্ডা
করেছেন বুড়োকর্তা।
ভেরোনার অল্পবয়সি ছেলেদের মাঝে রোমিওর
মতো সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান, সুন্দর যুবক আর কেউ নেই
সে কথা জানে জুলিয়েট। তার মনটা খুব খারাপ
হয়ে গেল যখন সে জানতে পারল রোমিও তাদের
পরম শত্রু মন্টেগু বাড়ির ছেলে।

No comments:

Post a Comment