Sunday, June 21, 2015

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০৪



গভীর রাত। শত চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারছে না
জুলিয়েট। বারবারই তার মনে পড়ছে রোমিওর
কথা, সেই সাথে কেটে যাচ্ছে ঘুমের রেশ।
বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে শেষে
বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল সে। চেয়ে দেখল একপাশে
কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে ধাইমা। সে যাতে টের না
পায় এমনভাবে খাট থেকে নেমে এল জুলিয়েট।
মোববাতির ক্ষীণ আলোতে মোটেও দেখা যাচ্ছে
না খোলা জানালার নিচে বিশাল বাগান,
গাছপালা, ফুল, আর লতাপাতা। এতক্ষণে রোমিও
আর মন্টেগুদের কথা ভেবে মাথা গরম হয়ে
উঠেছিল তার। বাগানের এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ার
স্পর্শে জুড়িয়ে গেল তার মন।
কখন যে তার অজান্তে আক্ষেপের সুরে কথাগুলি
বেরিয়ে এল জুলিয়েটের মুখ থেকে, ‘রোমিও!
কেন তুমি জন্মেছিলে মন্টেগু বংশে? তুমি কি
জান না সেতাই আমাদের মিলনের পথে প্রধান
অন্তরায়? তুমি যদি নামটা পালটে নাও তাহলে
এমন কী ক্ষতি হবে তোমার? তুমি কি জান না যে
নামে কিছু আসে যায় না—গোলাপকে যে নামেই
ডাক, তার সুগন্ধ নষ্ট হয় না?’
অনেক আগেই রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে
ক্যাপুলেটদের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসেছে
রোমিও ও তার দু-বন্ধু। কিছুদূর যাবার পর বন্ধুদের
অজান্তে ক্যাপুলেটদের প্রাচীর টপকে বাগানের
ভেতর লাফিয়ে পড়ল রোমিও। রোমিওকে না
দেখে তার দু-বন্ধু বেনভোলিও আর মার্কুসিও
বহুক্ষণ ডাকাডাকি করল তাকে। কিন্তু কোন
সাড়া পেল না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও
রোমিও ফিরে না আসায় তারা যে যার বাড়িতে
চলে গেল।
বাগানে নেমে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় সে এসে
পৌঁছাল জুলিয়েটের ঘরের জানালার নিচে। এমন
সময় উপর থেকে জুলিয়েটের আক্ষেপ তার কানে
এল। সে মুখ তুলে উপর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিকই
বলেছ। এখন থেকে রোমিও না বলে ‘প্রিয়তম’ বলে
ডেক আমাকে।’
রোমিওর গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে
জুলিয়েট বলল, ‘কে তুমি নিচে দাঁড়িয়ে আড়ি
পেতে আমার কথা শুনছ?’
রোমিও বলল, ‘নিজের পরিচয়টা না হয় গোপনই
থাক। কারণ নিজের নামটাকে ঘেন্না করি—ওটাই
আমার পরম শত্রু।’
খুশিভরা গলায় বলল জুলিয়েট, ‘তুমি না বললেও
আমি চিনতে পেরেছি তোমায়। তুমি নিশ্চয়ই
রোমিও, তাই না?’
রোমিও উত্তর দিল, ‘যদি ও নামটা তোমার পছন্দ
না হয়, তাহলে ধরে নাও ওটা আমার নাম নয়।’
জুলিয়েট জানতে চাইল, ‘আমাদের বাগানের এত উঁচু
পাঁচিল টপকে কীভাবে ভেতরে এলে তুমি?’
রোমিও বলল, ‘কোনও বাধাই প্রেমিককে
ঠেকাতে পারে না। সাহস থাকলে প্রেমিক যে
কোনও কাজ করতে পারে।’
জুলিয়েট বলল, ‘তুমি তো জান আমার পরিবারের
লোকদের, তোমায় পেলে তারা খুন করে ফেলবে।’
আবেগ মেশানো গলায় বলল, ‘সে ভয় নেই আমার।
তোমাকে দেখার জন্য তলোয়ারের আঘাত সইতেও
রাজি আমি।’
এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল ধাইমার। জুলিয়েটকে
বিছানায় দেখতে না পেয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে
পড়ল সে।
জুলিয়েটের নাম করে বেশ কয়েকবার ডাকল
ধাইমা। সে আওয়াজ কানে যেতে রোমিওকে
সাবধান করে দিয়ে দ্রুত এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল
জুলিয়েট। কিন্তু শুয়েও ছটফট করতে লাগল সে।
বারবার ছুটে এল জানালার সামনে। নিচে তখনও
রোমিও দাঁড়িয়ে। সারারাত জেগে তার সাথে
ভালোবাসার অনেক কথা বলল জুলিয়েট। ভোর
হবার সাথে সাথে বাগান থেকে বেরিয়ে গেল
রোমিও। যাবার আগে জুলিয়েটের কাছ থেকে
কথা আদায় করে নিল রোমিও যে সে তাকে
ভালোবাসে, বিয়ে করতেও রাজি আছে তাকে।
জুলিয়েট প্রতিশ্রুতি দিল বেলা হবার আগে সে
ধাইমাকে পাঠিয়ে দেবে তার কাছে—রোমিও
তার মারফত জানিয়ে দেবে কখন কোথায় তাদের
বিয়ে হবে।
সময় পেলেই শহরের বাইরে বেরিয়ে আসে রোমিও
—চলে যায় লরেন্স নামে সংসার ত্যাগী এক
সন্ন্যাসীর কাছে—নানা বিষয়ে আলোচনা হয়
তাদের মধ্যে। সন্ন্যাসীও খুব ভালোবাসেন
রোমিওকে। সেদিন শেষরাতে ক্যাপুলেটদের
বাগান থেকে বেরিয়ে বাড়িতে না ফিরে
রোমিও গিয়েছিল সন্ন্যাসীর কাছে।
জুলিয়েটকে সে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে
চায়—সে কথা সন্ন্যাসীকে বলেছিল রোমিও। আর
এও বলেছিল এ ব্যাপারে তারা পরস্পরকে
প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা সারতে
হবে গোপনে। জানাজানি হলে সর্বনাশ হয়ে
যাবে—কারণ ক্যাপুলেট আর মন্টেগু, উভয়
পরিবারের লোকেরাই চেষ্টা করবে সর্বশক্তি
দিয়ে এ বিয়ে বন্ধ করার। হয়তো দু-চারটে লাশও
পড়ে যেতে পারে।
রোমিও সন্ন্যাসীকে অনুরোধ করে বলল, ‘প্রভু! সব
কথাই তো আপনাকে খুলে বললাম। এবার আপনি
বিয়ে দেবার দায়িত্ব নিয়ে আমাদের বাঁচান।
সন্ন্যাসী ভেবে দেখলেন ক্যাপুলেট আর মন্টেগু, দুই
পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠলে
হয়তো অবসান হবে তাদের চিরশত্রুতার। সে
সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে তিনি রাজি হলেন
রোমিওর অনুরোধে। সন্ন্যাসীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে
রোমিও ফিরে গেল বাড়িতে। সারারাত খোলা
আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার দরুন প্রচণ্ড
ক্লান্ত তার শরীর, ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ,
ব্যথায় ছিঁড়ে যেতে বসেছে তার শরীর। কিন্তু এত
বাধা-বিপত্তির মাঝেও সন্ন্যাসীর কাছ থেকে
তার ও জুলিয়েটের বিয়ের আশ্বাস পেয়ে সব
কিছুকে তুচ্ছ করে এগিয়ে চলেছে রোমিও।
বেলার দিকে জুলিয়েট তাই ধাইকে পাঠিয়ে
দিল রোমিওর কাছে। ধাই মারফত রোমিও
জানাল জুলিয়েটের সাথে তার বিয়ের সব
ব্যবস্থা পাকা হয়ে আছে। বিকেলের দিকে যদি
সন্ন্যাসী লরেন্সের ওখানে যায়, তাহলে সেদিনই
তাদের বিয়ে হয়ে যাবে—সন্ন্যাসী নিজে
দাঁড়িয়ে থেকে তাদের বিয়ে দেবেন। ফিরে
গিয়ে ধাই সবকথা জানান জুলিয়েটক। গির্জায়
যাবে বলে মার অনুমতি নিয়ে সে দিন বাড়ি
থেকে বেরিয়ে এল জুলিয়েট। সবার অলক্ষে
গিয়ে হাজির হল সন্ন্যাসী লরেন্সের ডেরায়।
বিয়ের জোগাড় যন্তরের সব ব্যবস্থা আগে থেকেই
করা হয়েছিল। এবার সন্ন্যাসী লরেন্স বিয়ে
দিয়ে দিলেন রোমিও-জুলিয়েটের।
বিয়ের ক’দিন বাদেই দুর্ভাগতের ছায়া নেমে এল
রোমিওর জীবনে। বেনভোলিও আর মার্কুসিওর
সাথে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে গেল টিবল্টের।
সেদিন উৎসবের রাতে রোমিওকে হাতের কাছে
পেয়েও শায়েস্তা করতে না পারায় মনে মনে খুব
ক্ষোভ ছিল টিবল্টের। আজ রাস্তায় রোমিওর দু-
বন্ধু বেনভোলিও আর মার্কুসিওকে দেখতে পেয়ে
বেজায় গালাগালি দিতে লাগল টিবল্ট। সে যে
সহজে তাদের নিষ্কৃতি দেবে না একথা বুঝতে
পেয়ে তারা চেষ্টা করলেন টিবল্টকে নিরস্ত
করতে, ঠিক সে সময় সেখানে এসে হাজির হল
রোমিও। তাকে দেখতে পেয়ে খাপ থেকে
তলোয়ার বের করল টিবল্ট।
সব সময় বিবাহিত রোমিওর চোখের সামনে ভেসে
বেড়াচ্ছে স্ত্রী জুলিয়েটের কচি লাবণ্যভরা
মুখখানি। টিবল্ট আবার সম্পর্কে জুলিয়েটের
ভাই। তাই তাকে তো আর চট করে আঘাত করা যায়
না। টিবল্টের কথায় রেগে না গিয়ে সে চেষ্টা
করল তাকে শান্ত করতে, কিন্তু উলটো ফল হল
তাতে। টিবল্ট ধরে নিল রোমিও একজন কাপুরুষ।
তাই সে ইচ্ছে করেই মন্টেগু বংশের সবার নামে
গালাগালি দিতে লাগল।
টিবল্টকে শায়েস্তা করা মোটেই শক্ত কাজ নয়
রোমিওর পক্ষে। কিন্তু টিবল্ট যে জুলিয়েটের
ভাই, সে কথা মনে ভেবে চুপ করে রইল সে। কিন্তু
মার্কুসিওর কাছে অসহ্য মনে হল টিবল্টের
ব্যবহার। সে তলোয়ার হাতে তেড়ে গেল
টিবল্টের দিকে।
এবার সমস্যায় পড়ে গেলেন রোমিও—একদিকে
জুলিয়েটের ভাই টিবল্ট, অন্যদিকে তার প্রধান
বন্ধু মার্কুসিও, এদের যে কেউ আহত বা মারা
গেলে চরম ক্ষতি হবে তার। তাদের বাঁচাতে
রোমিও ঝাঁপিয়ে পড়লেন উভয়ের উদ্যত
তলোয়ারের মাঝে। সাথে সাথে তার তলোয়ার
সরিয়ে নিল মার্কুসিও, কিন্তু টিবল্ট তা করল না।
রোমিওকে ঢালের মত ব্যবহার করে সে সজোরে
আঘাত হানল মার্কুসিওর বুকে। মার্কুসিও আহত
হয়ে মাটিতে পড়ে যাবার কিছুক্ষণ বাদেই মৃত্যু
হল তার।
এভাবে মার্কুসিওকে মরতে দেখে খুন চেপে গেল
রোমিওর মাথায়। তখন জুলিয়েটের কথা আর মনে
রইল না রোমিওর। সে তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে
পড়ল টিবল্টের উপর। তার তলোয়ার সোজা গিয়ে
বিঁধল টিবল্টের হৃৎপিণ্ডে। সে আঘাতে রাস্তায়
পড়ে গিয়ে ছটফট করতে করতে মারা গেল
রক্তাক্ত টিবল্ট।
টিবল্টের মৃত্যু দেখে হুঁশ ফিরে এল রোমিওর। সে
নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল উত্তেজনার বশে
এরূপ কাজ করার জন্য। কিন্তু এবার কী হবে? কোন
মুখে সে দাঁড়াবে জুলিয়েটের সামনে?
রাস্তার উপর পাশাপাশি পড়ে রয়েছে মার্কুসিও
আর টিবল্টের মৃতদেহ দুটি। এদিকে কৌতূহলী
জনতার ভিড়ও ক্রমশ বেড়ে উঠছে। অনেক দিনই
ভেরোনার রাজা আদেশ দিয়েছিলেন রাজপথে
যে দাঙ্গা বাধাবে তার প্রাণদণ্ড হবে। কার এত
দুঃসাহস রাজাদেশ লঙ্খন করে ভর দুপুরে এমন কাণ্ড
বাধাল! খবর পেয়ে রাজা নিজেই ছুটে এলেন
ঘটনাস্থলে। রাজাকে সব কথা খুলে বললে
বেনভোলিও। সে আরও জানান ক্যাপুলেট বাড়ির
টিবল্টই প্রথম আক্রমণ শুরু করেছিল। মার্কুসিওর
হত্যাকারী সে। আত্মরক্ষার খাতিরেই প্রতি-
আক্রমণ করতে হয়েছিল রোমিওকে, তারই ফলে
মারা যায় টিবল্ট। সে কথা শুনে প্রাণদণ্ডের
পরিবর্তে রোমিওকে নির্বাসন দণ্ড দিলেন
রাজা। রাজাদেশ তৎক্ষণাৎ ভেরোনা ছেড়ে
মান্টুয়ায় আশ্রয় নিতে হল রোমিওকে। এমনকি
জুলিয়েটের সাথে দেখার করার সময়টুকু পর্যন্ত
তাকে দিলেন না 

No comments:

Post a Comment